নকশি কাঁথা সম্পর্কে তথ্য

নকশি কাঁথা সম্পর্কে তথ্য আপনাদের জানাবো আজকের এই পোস্টে। নকশি কাঁথা আমাদের দেশীয় সম্পদ। প্রাচীনকাল থেকেই নকশি কাঁথা নিয়ে আমাদের আগ্রহ অনেক বেশি।চলুন নকশি কাঁথা সম্পর্কে তথ্য গুলো জেনে নিই।
নকশি-কাঁথা-সম্পর্কে-তথ্য
আজকের এই পোস্টে আপনারা জানতে পারবেন একালের নকশি কাঁথা এবং নকশি কাঁথার ইতিহাস সম্পর্কে।পোস্টটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন।এবং নকশী কাঁথা সম্পর্কে তথ্যগুলো জেনে নিন। আশা করছি ভালো লাগবে।

পেইজ সূচিপত্র: নকশি কাঁথা সম্পর্কে তথ্য

নকশি কাঁথা সম্পর্কে তথ্য 

নকশি কাঁথা সম্পর্কে তথ্যগুলো আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরবো। নকশি কাঁথা আমাদের দেশের প্রাচীন ঐতিহ্য। এটি আমাদের দেশের একটি গৌরবময় সম্পদ । আমাদের দেশের কারু শিল্পীদের নিপুন হাতের পরিপাটি কাজ গুলো ফুটে ওঠে নকশি কাঁথার মাধ্যমে। সে আদিকাল থেকে আজ অব্দি নকশী কাঁথার চাহিদা রয়েছে একই সমান। সবার মন জয় করে এখনো টিকে আছে ঐতিহ্যেবাহি নকশি কাঁথা।

নকশি কাঁথার কদর একটুও কমেনি। নকশি কাঁথা কালের গর্ভে হারিয়ে যায়নি। বরং দিনের পর দিন নকশীকাঁথার চাহিদা বেড়েই চলেছে। যোগ হয়েছে আরো নানারকম নানা ডিজাইনের কাজ। অদম্য পরিশ্রমের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছে নিজেদের প্রতিভা নকশীকাঁথার মাধ্যমে। প্রতিটা বাঙালির ঘরেই নকশী কাঁথা চোখে পড়ে। এমন কোন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না যে তার বাসায় নকশীকাঁথার ব্যবহার নেই। 

এটি যেন ঘরের বিছানার এক অপরূপ সৌন্দর্য। নকশি কাঁথা আমাদের হস্তশিল্পের অন্যতম গৌরব। শুরুর দিকে নকশী কাঁথার ব্যবহার গ্রামের দিকে অনেক বেশি ছিল। এখন শহরের দিকেও ভীষণভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক চড়া দামে বিক্রি হয় হাতে তৈরি কৃত নকশি কাঁথা। পুরানো কাপড় দিয়ে তৈরি হতো নকশি কাঁথা।এখন প্রয়োজনের ক্ষেত্রে এবং ভালোলাগা থেকে নতুন গজ কাপড় কিনে নতুন সুতা দিয়ে নানা রকম ডিজাইন করা হচ্ছে নকশি কাঁথার।

নকশি কাঁথার ইতিহাস 

নকশী কাঁথার ইতিহাস যত বলব তত কম হয়ে যাবে। নকশি কাঁথা একটি প্রাচীন ঐতিহ্য। এটির ব্যবহার চলে আসছে দীর্ঘ সময় ধরে। প্রাচীন মানুষের এটি একটি অনন্য আবিষ্কার। নকশি কাঁথার সাথে আমরা কম বেশি সকলেই পরিচিত। এটি আমাদের কারো কাছেই অচেনা কিছু নয়। ছোট থেকে বড় এর বিষয়ে সকলেই জানে। আমাদের দেশে এমন কোন মা বোন পাওয়া যাবে না যাদের বাসায় নকশি কাঁথার ব্যবহার নেই। 

হস্তশিল্পর কথা মাথায় আসলে তার শীর্ষে থাকবে নকশি কাঁথা। গ্রাম গঞ্জে নকশীকাঁথার আবিষ্কার যেন যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। প্রাচীন সব আবিষ্কারের মধ্যে নকশি কাঁথা স্থান সবার উঁচুতে। এটি এখনো মানুষের মন জয় করে রয়েছে ভীষণভাবে। সংস্কৃত এবং প্রাকৃত শব্দ মিলে নকশি কাঁথা কথাটির উৎপন্ন হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কাঁথা শব্দের আভিধানিক অর্থ হল জীর্ণশীর্ণ কাপড় থেকে তৈরি কৃত গায়ে দেওয়া মোটা শীতবস্ত্র বিশেষ।

নকশি কাঁথার ইতিহাসে গ্রামীণ বাঙালি মানুষের কথার বচনভঙ্গি আলাদা হওয়ার কারণে নকশী কাঁথা কে নানান রকম  নামে ডাকা হয়। যেমন: খেতা, কাঁথা, ক্যাথা, কেথা ইত্যাদি। রংপুর ,ঠাকুরগাঁ ,দিনাজপুর এসব অঞ্চলের মানুষ কাঁথা কে দাগলা , গুদুরী বলে থাকে। আবার অনেক জায়গায় নকশীকাঁথার নাম সাজের কথা। গ্রামের বধু ও কন্যারা সুচ নিয়ে এবং পুরনো কাপড় দিয়ে তার জোড়া লাগিয়ে তৈরি করত নতুন নকশি কাঁথা। 

গ্রামের দিকেই নকশীকাঁথার প্রচলন শুরু হয়। এখন অবশ্য তা শহর জুড়ে আখ্যায়িত হয়েছে। আগে তৈরি হতো পুরনো কাপড় দিয়ে। এখন মানুষ শখের বসে নতুন কাপড় দিয়ে নানান রকম কাথা তৈরি করে। গ্রামের কন্যা ও বধূরা নানা রকম রূপ রং বর্ণবৈচিত্র এবং তাদের প্রতিভা দিয়ে ফুটিয়ে তোলে নকশি কাঁথা। নকশি কাঁথায় আমরা খুঁজে পাই এক অপরূপ সৌন্দর্য ,সমাজ সভ্যতা ,প্রাকৃতিক অপূর্ব সৌন্দর্য, সুপ্র প্রাচীর এর ঐতিহ্য।

এটি সাধারণত গ্রাম বাংলার মহিলার শিল্পকর্ম হিসেবে পরিচিত। এই শিল্পকর্ম আমাদের অর্থনৈতিক সমাজেও জড়িয়ে আছে। নকশী কাঁথার ইতিহাস থেকে জানা যায় নকশী কাঁথা প্রয়োজনের তাগিদে আবিষ্কৃত হয়। গ্রামের অসহায় মানুষ শীত নিবারণের জন্য এই দারুন কাজের বীজ বপন করে।এখন তার প্রয়োজনীয়তা এবং সৌন্দর্য মুগ্ধ করেছে সব ধরনের মানুষকেই।গ্রাম বা শহর সব জায়গাতেই নকশি কাঁথার প্রচলন রয়েছে ভীষণভাবে।

একালের নকশী কাঁথা নিয়ে কিছু কথা 

একালের নকশি কাঁথা নিয়ে কিছু কথা আপনাদের সামনে আজ তুলে ধরবো। নকশীকাঁথার ব্যবহার সেকাল থেকে একাল পর্যন্ত চলে আসছে মানুষের মন জয় করে। দিনের পর দিন যেন নকশী কাঁথার ব্যবহার বেড়েই চলেছে। নিত্য প্রয়োজনীয় এক দারুন আবিষ্কার এই নকশি কাঁথা। একালের নকশি কাঁথা খুবই চাহিদা পূর্ণ পণ্য। শহর হোক বা গ্রাম নকশী কাঁথার চাহিদা সচরাচর অনেক বেশি। 
 
আগেকার নকশি কাঁথা ছিল ব্যাপক ব্যবহৃত এবং চাহিদা পূর্ণ। ব্যবহার অনুযায়ী নকশী কাঁথার কিছু ভিন্নতা দেখা যায়। যত দিন যাচ্ছে তত নতুন আবিষ্কার যেন বেড়েই চলেছে। এখনকার তুলনায় আগেকার নকশি কাঁথা একটু সাধারণ ছিল। এখনকার নকশি কাঁথা ফুটে উঠছে নানা বিচিত্রর ছবি। যে যার পছন্দ মতো আর্ট করছে। কেউ করছে অনেক ঘন কাজ কেউ বা হালকা। 

তৈরি করছে নানা প্রয়োজনীয় পণ্য। শীতে গায়ে দেওয়ার জন্য লেপ কাঁথা। নামাজের জন্য জায়নামাজ। বালিশে ব্যবহার করার জন্য ছোট কথা। হিন্দুদের ঠাকুরের আসন। বাচ্চাদের জন্য ছোট কথা। বিছানায় মেলার জন্য বড় কাঁথা। এছাড়াও নানা রকম ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এই নকশি কাঁথা। এলাকা ভেদে নানান নকশীকাঁথার নানান নাম রয়েছে। এবং দেখা যায় নানা রকম বৈচিত্র্যময় কাঁথা। 

মেয়েদের বিয়েতে কাছের মানুষ বা মায়ের কাছ থেকে মেয়েরা কাঁথা উপহার পায়। যে যা কাছের মানুষের জন্য অনেক মমতা দিয়ে কাথা তৈরি করে। মেয়ে মায়ের জন্য, মা মেয়ের জন্য, স্ত্রী তার স্বামীর জন্য, এছাড়াও মেয়েরা খালা, ফুপু ,নানী , দাদীর কাছ থেকে কাঁথা উপহার পায়। প্রচলন আদিমকালের হলেও এখনো ফুরিয়ে যায়নি কাথা দেওয়ার রেওয়াজ। ভীষণভাবে বিচরণ আছে আমাদের মাঝে এই নকশী কাঁথার। 

এই আধুনিকতার ভিড়ে এবং চাহিদার প্রেক্ষাপটে আমাদের ঐতিহ্যবাহী শিল্পকর্মের কিছু পরিবর্তনে এসেছে। যা বলা যায় সুন্দর রূপ ধারণ করেছে। ব্যাপক চাহিদার জন্য নকশি কাঁথায় এসেছে নতুনত্ব। দেশীয় সুতার পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে নতুন মার্কিন লালসালু কিংবা কালো কাপড় এবং বিদেশী সিল্ক পেটি সুতা। এবং শখের বসে বা ভালোবেসে নতুন কাপড় কিনে অতি যত্নে তৈরি হচ্ছে নকশি কাঁথা।

নকশি কাঁথা যেভাবে তৈরি করা হয় 

নকশি কাঁথা যেভাবে তৈরি করা হয় সে নিয়মটা আপনাদের সাথে শেয়ার করি চলুন। আমাদের দেশে গ্রামের মা-বোন আগে শুধু প্রয়োজনের তাগিদে এবং পরিবারের জন্য তৈরি করতেন নকশি কাঁথা। গ্রামে বর্ষাকালে যখন কোন কাজ থাকে না মা-বোনরা ঘরে বসে অবসর সময়ে নকশি কাঁথা সেলাই করতো। এতে বর্ষার কালে সময় কেটে যেত। এখনো যে সেই ধারা হারিয়ে গেছে তা মোটেও নয়। গ্রামীণ জীবনে এ ধারা এখনো লক্ষ্য করা যায়।  
 
নকশি কাঁথা সব জায়গাতেই তৈরি হয়। সর্বত্র দেশেই নকশী কাঁথা তৈরি হয়। নকশি কাঁথার মূল উপাদান হল পুরাতন কাপড় এবং রংবেরঙের সুতা। এখন অনেকেই নতুন কাপড় ব্যবহার করে। অন্যকে বা মেয়েকে উপহার দেয়ার জন্য পরিপাটি ভাবে তৈরি করে নকশি কাঁথা। নকশি কাঁথা তৈরীর নিয়ম হলো: প্রথমে মাটিতে সপ বা পার্টি বিছিয়ে নিতে হয়। এরপর আপনি কথাটা যত বড় করতে চান তার মাপে কাপড় সেলাই করে নিতে হবে মাঝখান দিয়ে। 
নকশি-কাঁথা-সম্পর্কে-তথ্য
যে যার পছন্দ মতো মাপ নিয়ে থাকে। কেউ চার হাত পাঁচ হাত, কে বা পাঁচ হাত ছয় হাত। এটি ছোট বড় হতে পারে। এরপর একটা একটা করে কাপড় বিছিয়ে নিয়ে চার পড়ল বা পাঁচ পরল কাপড় দেওয়া হয়। তারপর কাপড় গুলো চারিদিক থেকে সেলাই করে নেয়। কেউ চাইলে লেজ ও লাগাতে পারে চারি দিকে। কথাটা সেলাই করতে তো এক মাস বা দুই মাস সময় লাগবে। তাই পুরো কথা ঘুরে ঘুরে বড় বড় করে ১০ থেকে ১৫ লাইন সেলাই করে নেওয়া হয়।

তারপরে সেলাই এর আগে এক ঘন্টা রোদে দিয়ে শুরু হয় নকশি কাঁথা সেলাই। কিছুক্ষণ রোদে দিয়ে রাখলে সেলাই করার সুবিধা হয়।। তারপর যে যার পছন্দ মত রঙিন সুতা দিয়ে নকশি কাথার ওপর ডিজাইন করে। যে কাপড় দিয়ে নকশী কাঁথা তৈরি করা হয় সেটি যদি এক রঙের কাপড় হয় তাহলে সাধারণত তার ওপর নানা রকম গাছ,লতা, পাতা ,পাখি ,ইত্যাদি ডিজাইন করা হয়। আর যদি সেটা প্রিন্টের কাপড় হয় তাহলে সাদা সেলাই করা হয়।
 
এছাড়াও নানারকম সেলাই আছে। কেউ লেজের সেলাই করে পুরো কথা সুন্দর করে ডিজাইন করে। কেউ যদি মনোযোগ দিয়ে সেলাই করে তাহলে ১৫ দিনে কাঁথা সেলাই করা শেষ হয়ে যায়। তবে কাঁদাতে লেজ বা ঘন কাজ থাকলে সে ক্ষেত্রে দেরি হয় দুই মাস অথবা তিন মাস। কত দিনে কাঁথা শেষ হবে তা নির্ভর করবে যে সেলাই করবে তার ওপর। এভাবেই কাঁথা তৈরি হয় তবে অঞ্চল ভেদে আলাদা হতে পারে। 

নকশী কাঁথার নাম এবং সেলাইয়ের নাম 

নকশি কাথার নাম এবং সেলাইয়ের নাম চলুন জেনে নিই। নকশী কাঁথা সেলাই করার জন্য নানা রকম সেলাই আমরা ব্যবহার করে থাকি। যে যার ইচ্ছা এবং প্রতিভা দিয়ে নানা রকম চিত্র কাথায় তুলে ধরি। অনেকে তা সাদা করেও সেলাই করে থাকে। কিছু উল্লেখযোগ্য সেলাইয়ের নাম শেয়ার করি চলুন। যেমন: বাঁশপাতা সেলাই, বোতাম ঘর, হিয়ারিং সেলাই, চেন সেলাই, উল্টা ফোর, সাদা সেলাই, গুটি সেলাই, ঘাট সেলাই,।

এছাড়াও রয়েছে তোলা সেলাই, বোরকা ফ্লোর, কাঁটা ফোর,তারা ফোর, রান ফোর, ধানসিড়ি, ফল সেলাই, কাঁচি ধারা ইত্যাদি। আরো নানা সেলাই আছে। সেলাই গুলোর নাম এলাকা ভিত্তিতে আলাদা হতে পারে। নানা রকম সেলাইয়ের মাধ্যমে কাঁথা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয়। এবং ছোট বাচ্চাদের কাঁথাতে ছোট ছোট ফুল পাখি পাতা দিয়ে ডিজাইন করা হয়। আপনি আপনার পছন্দ মত কাথায় ডিজাইন করতে পারেন ।তৈরি করতে পারেন নকশি কাঁথা। 
 
এবার জেনে নিন কিছু ঐতিহ্যবাহী নকশীকাঁথার নাম এবং তার কিছু ব্যবহার। 
  • লেপ কাঁথাঃ লেপকথার সাধারণত শীতের সময় ব্যবহার করা হয়। এতে শীত থেকে বাঁচার জন্য ব্যবহৃত হয়। সাধারণত পুরু আর ভারি হয়। 
  • সুজনী কাঁথাঃ সজনী কাঁথা সাধারণত বিছানার চাদর বানানো হয়। এটি পাতলা করে তৈরি করে উপরে নানা রকম ডিজাইন করা হয়।। এবং এই রঙিন কথাটি বিছানার ওপরে পেড়ে রাখা হয়। 
  • রুমাল কাঁথাঃ এটি রুমাল হিসেবে ব্যবহার হয়। রুমাল এ নানা রকম ডিজাইন করে ব্যবহার করা হয়। আপনি চাইলে উপহারও দিতে পারেন। 
  • বোচকা কাঁথাঃ এটি আগেকার মানুষ বেশি ব্যবহার করত। এর মধ্যে প্রয়োজনীয় জিনিস রেখে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া যেত। 
  • গিলাফ কাঁথাঃএখানে আল কুরআন বা অন্যান্য ধর্মীয় যে কোন পুস্তক এর খোল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। 
  • চাদর কাঁথাঃএটি শীতকালে গায়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। চাদরের মতো করে এটি ব্যবহার করা হয়।
  • আসন কাঁথাঃ এটি হিন্দুদের আসন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পূজার সময় বা বর কনেকে বসানোর জন্য এটি ব্যবহৃত হয়। 
  • নকশি থলেঃ নকশিত থলে বিভিন্ন জিনিস পরিবহন করার জন্য ব্যবহৃত হয়। আগেকার দিনে বয়স্ক দাদা-দাদি এটাতে পান রাখত। 
  • পাটি কাঁথাঃ বাসায় যখন আত্মীয়-স্বজন আসে তখন এই পার্টি কাঁথাতে বসতে দেওয়া হয়। 
  • বেবি কাঁথাঃ এই কথাগুলো ছোট বাচ্চাদের জন্য তৈরি করা হয়। এই ছোট ছোট কাঁথা গুলো বাচ্চাদের ঘুমিয়ে রাখা বা গায়ের উপর দিয়ে রাখার কাজে লাগে।
  • পাদানি কাঁথাঃএই কথাগুলো দরজার সামনে বা বিছানার নিচে রাখা হয়। ব্যবহৃত হয় সাধারণত পা মোছার জন্য। 
  • এমন নানা নামের কাঁথা ব্যবহৃত হয় আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। এগুলো এলাকা ভেদে নানারকম নামে আপনাদের সামনে উপস্থিত হতে পারে। কারণ অঞ্চল ভেদে ভিন্ন নামে পরিচিত হয় কথাগুলো।

নকশি কাঁথার আলপনা বা মোটিফ

নকশী কাঁথার আলপনা বা মোটিফ নানা রকম হয়ে থাকে যে যার প্রতিভা দিয়ে নিজের মনের সৌন্দর্য গাধার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলে। নকশি কাঁথা অঞ্চল ভেদে নানারকম ডিজাইন করা হয়ে থাকে। কাঁথাতে নানা রকম ফুল লতাপাতা বৃক্ষ এবং জ্যামিতিক নকশা করা হয়।। যেকোনো কাঁথা একটি মূল নকশা থাকে যেটাকে ঘুরে ঘুরে পুরো কাঁথা সম্পূর্ণ করা হয়। চার কণা অথবা গোল কোন ডিজাইন থাকে যেটাকে ঘিরে সম্পূর্ণ ডিজাইন শেষ করা হয়।
 
বাংলাদেশের নকশি কাঁথায় যে ধরনের মোটিফ দেখা যায় তা হল: পদ্মফুল, জীবন বৃক্ষ, ঢেউ, পাহাড়, মাছ ,নৌকা, ফুলের বাগান, অষ্ট দল, চরকা ,পায়ের ছাপ, হাতপাখা, পশুপাখি ,কলস ,চাঁদ ,তারা ,সূর্য ,হাতি ,ঘোড়া, ময়ূর, নাম না জানা নানান ফুল, আলপনা, রাজা রানী, রান্নাঘরের নানান আসবারপত্র, ছোটদের খেলনা, পাখি, রঙিন পাখনা, ইত্যাদি নানা রকম সুন্দর সুন্দর ডিজাইন করা হয়। 

যে যার প্রতিভা দিয়ে গ্রামীণ দৃশ্য এবং জীবনচিত্র ফুটিয়ে তোলে। এ যেন শিল্পীর এক মহৎ গুণ। এবং প্রকৃতির কাছে আলপনার মাধ্যমে আত্মসমর্পণ। জীবনচিত্র ভালোলাগা খারাপ লাগা দৈনিন্দন জীবনের পারিপার্শ্বিক অনেক কিছুই ফুটিয়ে তোলে। ফুটে ওঠে মানুষের বৈচিত্র জীবন। শিল্পীর অক্লান্ত পরিশ্রমে যেন চিত্রটি জীবিত হয়ে। প্রাণ ফিরে পায় হস্তশিল্পের হাতের ছোঁয়ায়। দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়।

নকশী কাথার কি সুতা ব্যবহৃত হয় 

নকশী কাথার কি সুতা ব্যবহৃত হয়? নকশি কাঁথা জীবন তো করার প্রথম শর্ত রংবেরঙের সুতা। সুতার ছোঁয়ায় সৌন্দর্য এতটাই বেড়ে যায় দেখে মনে হয় যেন নকশী কাঁথা কথা বলবে। বিভিন্ন রকম রং এর ছোয়ায় যেন মুক্তা ঝরে নকশি কাঁথায়। যে যার পছন্দ মত মিলিয়ে মিলিয়ে নানা রকম সুতা ব্যবহার করে থাকে। তবে খেয়াল রাখতে হবে কোন কালার কাপড়ের ওপর কোন কালার সুতাটা বেশি ফুটে উঠবে।

সাদা, কালো, সবুজ ,লাল, নীল, হলুদ ,লেমন ইত্যাদি চকচকে রঙের ছোঁয়ায় কয়েক গুণ সৌন্দর্য বেড়ে যায় নকশি কাঁথার।আগে বিভিন্ন কালার দেশীয় সুতা ব্যবহার করা হতো। এখন দেশীয় সুতার পাশাপাশি মার্কিন সুতা ব্যবহৃত হচ্ছে। গাট সুতার প্রচলন রয়েছে প্রচুর। এছাড়াও ব্যবহৃত হয় রুলের সুতা। এবং বিশেষ প্রয়োজনে প্যাঁচানো সুতোগুলো ব্যবহৃত হয়। সুতা দিয়ে লেজ দেওয়া হয়।

 তৈরির সময় কাটিং ও ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও এসেছে বাজারে নানা রকম সুতা যেগুলো ব্যবহার করা হয়। সুতার কাজ করার আগে পেন্সিল দিয়ে আর্ট করে নেওয়া হয় নকশীকাঁথার ওপরে। এতে সেলাই করার সুবিধা হয়। আবার অনেকেই আছে অন্য কারো থেকে আর্ট করে নিয়ে নিজে সেলাই করে। সে ক্ষেত্রে পেন্সিলের ব্যবহার বাধ্যতামূলক। এরকম ছোট ছোট কিছু টিপস অবলম্বন করে নকশী কাঁথার সৌন্দর্য দ্বিগুণ করা হয়।

নকশি কাঁথার মান ও বৈশিষ্ট্য 

নকশী কাঁথার মান ও বৈশিষ্ট্য সেলাইয়ের উপর বা কাপড়ের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তন হতে পারে। সেলাইয়ের ভিন্নতার কারণে এবং অঞ্চল ভেদে গাধার মান আলাদা হয়। সেলাইয়ের ওপর নির্ভর করবে কাছার মান। এবং কথাটি কতটা টিকসই হবে সেটি কাপড় এবং সুতার ওপর নির্ভর করবে। কাপড় যদি নতুন হয় সুতা ভালো হলে আর আপনার সেলাই যদি ছোট ছোট ঘন ঘন হয় তাহলে সেই কথার মান ভালো এবং তার বৈশিষ্ট্য উন্নত মানের মধ্যে পড়বে।  
নকশি-কাঁথা-সম্পর্কে-তথ্য
কম দামে সুতা বা নরম সুতা এবং খুব বেশি পুরানো কাপড় হলে কাথাটা টেকসই হয় কম। এখন নিজেদের ব্যবহারের পাশাপাশি বিভিন্ন কথা বিক্রিও করা হয়। এবং এটা চাহিদাও রয়েছে প্রচুর। যেসব এলাকাতে কাঁথার কম তৈরি হয় কিন্তু চাহিদা বেশি সেসব এলাকায় উচ্চ দামে কাথা বিক্রি হয়। কোন সেলাই এবং লেজ দেওয়া সেলাই গুলোর চাহিদা অনেক বেশি। এগুলোর দামও হয় চড়া। 

প্রতিটি অঞ্চলের নকশি কাঁথা রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। নকশী কাঁথার ফোর্স সেলাই এবং ব্যবহৃত নকশা দেখে বোঝা যায় যেটি কোন অঞ্চলের এবং কি মানসিকতা থেকে তৈরি হয়েছে। তাই আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য কাথায় প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করে কাঁথার মান নির্বাচনে। কাথার বৈশিষ্ট্য এবং মান দেখে নির্বাচন করা যাবে এলাকা। চলুন দেখে নেওয়া যাক বৈশিষ্ট্যগুলো
  • চাঁপাইনবাবগঞ্জের নকশি কাঁথাঃ চাপাইনবাবগঞ্জের নকশি কাঁথা, কাথার ফোর, কাঁথার কাপড় অন্যান্য এলাকা থেকে আলাদা হয়। এলাকার কিছু কথা খুব উন্নত এবং নামকরা। যেমন: লহরী কাথা, সুজনীকাঁথা, লিক কাঁথা, কার্পেট কাঁথা, চোখ টানা কাঁথা,।
  • রাজশাহী বগুড়া ও কুষ্টিয়া অঞ্চলের নকশি কাঁথাঃ এইসব এলাকার নকশি কাঁথা আকারে বড় এবং পুরো হয়। তবে সেলাই তেমন সূক্ষ্ম হয় না। জ্যামিতিক নকশা ফুল লতাপাতা নকশা এবং নানান ধরনের ডিজাইন ব্যবহার করে থাকে। 
  • যশোর ফরিদপুর ও খুলনা অঞ্চলের নকশি কাঁথাঃ এসব এলাকার নকশি কাঁথা আকারে একটু ছোট হয়। সেলাই হয় অত্যন্ত সুক্ষ। মানুষ ও পশু পাখি মোটিফ বেশি ব্যবহার করা হয় এসব নকশি কাঁথাতে।
  • ঢাকার নকশি কাঁথাঃ ঢাকার নকশি কাঁথাগুলো খুব পাতলা হয়। ঢাকার নকশী কাঁথাগুলো হয় খুব সাধারন ডিজাইন। ছোট ছোট ফুল এবং পাতা এগুলোই থাকে ঢাকার নকশি কাঁথায় বেশি পরিমাণে।

নকশীকাঁথার দাম কত?

নকশি কাঁথার দাম কত?দাম সম্পর্কে আপনারা অনেকেই জানতে চান। নকশি কাঁথা এখন কিনতে পাওয়া যায়। আগে গ্রাম বাংলার মেয়েরা বধূরা নিজের প্রয়োজনে নকশি কাঁথা তৈরি করতো। যেন দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করতে পারে। বিয়ের সময় কাথা দেওয়ার একটি রেওয়াজ ছিল। কিন্তু এখন শুধু ব্যবহারের জন্য কাঁথা তৈরি হয় না। এখন কাঁথা বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
 
অনেক মেয়েরা ঘরে বসে কঠোর পরিশ্রম করে কাথা সেলাইয়ের মাধ্যমে নিজের পাড়ে দাঁড়িয়েছে। যদি একজন কাঁথা বানিয়ে অন্যজনকে সেলাই করতে দেয়। তাহলে সাদা সেলাইয়ের ক্ষেত্রে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা মজুরি হয়। আর যদি নকশা বা লেজের কাঁথা হয় তাহলে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা মজুরি হয়ে থাকে। শহরে নকশী কাঁথা কিনতে গেলে ৩০০০ থেকে ৩৫০০ টাকা লাগবে। লেজ বা ঘন কাজ হলে টাকার পরিমাণ আরো বাড়বে।
 
তবে অঞ্চল ভিত্তিতে টাকার পরিমাণ আলাদা হতে পারে। চাহিদার ওপর ও নির্ভর করে নকশি কাঁথার দাম। কাঁথা ছোট বড় হলেও দাম কম বেশি হবে। যেসব অঞ্চলে চাহিদা বেশি কিন্তু কাঁথা সাপ্লাই কম সেসব অঞ্চলে  কাঁথার দাম হয় উচ্চ। যেমন ঢাকাতে কাঁথা কিনতে গেলে আপনাকে বেশি টাকা গুনতে হবে। আবার যদি একই কাঁথা রাজশাহীতে নিতে চান তাহলে কিছুটা কমের মধ্যেই পেয়ে যাবেন। এমন ভিন্নতা দেখা দেবে।

মন্তব্যঃ নকশি কাঁথা সম্পর্কে তথ্য 

নকশি কাঁথা সম্পর্কে তথ্য আজকে আপনাদের জানানোর চেষ্টা করেছি। নকশি কাঁথা হচ্ছে আমাদের প্রাচীনতম এক অন্যতম সৌন্দর্য। সেটি আমাদের প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি ধরে রেখেছে ঐতিহ্য কেউ। এক অপরূপ আবিষ্কার। তাই আমাদের সকলের উচিত নকশি কাঁথার ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখা। এর প্রয়োজনীয়তা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। নকশী কাঁথার সুন্দর যে মুগ্ধ হয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। 

এটি নিত্য প্রয়োজনীয় অতি সুন্দর্যের একটি পণ্য। প্রয়োজন মেটানোর সাথে সাথে এটি বাণিজ্যিকভাবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। এবং গ্রামের অসহায় মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে নকশি কাঁথা বিক্রির মাধ্যমে। আশা করি আপনাদের সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়েছেন আজকের পোস্টে। এরপরেও যদি আপনাদের কিছু জানার থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। অবশ্যই জানানোর চেষ্টা করব। 
 
 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ডেইলি ডাইরির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url